রচনা : মহত্ত্ব

↬ মানবতা ও মহত্ত্ব

ভূমিকা : “মহৎ যে হয় তার সাধু ব্যবহার”-এ-কথাটি কোনো একজন কবির। কবি এ-কথাটি দ্বারা একজন মহৎ মানুষের মূল্যায়ন করেছেন, অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, সাধু ব্যবহারের দ্বারা একজন মানুষের মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে। মহৎ মানুষের মধ্যে মহত্ত্বসহ তার অন্যান্য গুণ নিহিত থাকে। সুতরাং মহত্ত্বের ব্যাপ্তি বা পরিসর বিশাল। মানুষের মহত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গেলে এককথাই বলতে হয় যে, মানুষের সকল মানবীয় গুণের সমন্বিত পরিশীলিত বহিঃপ্রকাশই হল মানুষের মহত্ত্ব। 

পশুত্ব ও মনুষ্যত্ব : ইতর-প্রাণীদের মধ্যে শুধুমাত্র পশুত্বই বলশালী। তাদের মধ্যে জ্ঞানের উপস্থিতি একেবারে যে নেই তা নয়, তবে তার মাত্রা অতিশয় নগণ্য। পশুর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনার ক্ষমতা নেই। তাই ইতর-প্রাণীকুল পশুত্বের বা পাশবিক শক্তির বশবর্তী। মানুষ বুদ্ধিমান জীব। তাই সে বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনার নির্দেশে পরিচালিত হয়। জীব হিসেবে মানুষের মধ্যে পশুত্বও থাকে; -পাশবিক শক্তিও তাকে প্রভাবিত করে। তবে মানুষের মধ্যে পশু-শক্তির পাশাপাশি তার মধ্যে বিবেচনা শক্তিও বিদ্যমান। তাই মানুষ বিবেকের পরিচালনায় পরিচালিত হয়ে তার মনের পশু-শক্তিকে শৃঙ্খলিত করে রেখে মনুষ্যত্ব গুণকেই অন্তরে সদাজাগ্রত করে রাখে। সৃষ্টিকর্তা পশুর মধ্যে জ্ঞান দান করেন নি, কিন্তু মানুষের মধ্যে জ্ঞান দান করেছেন। এর ফলে মানুষ জ্ঞানের আলোকে ইতর-প্রাণী অপেক্ষা জীব হিসেবে বহুগুণ শ্রেষ্ঠ। 

মহৎ মানুষের পরিচয় : যেসব মানুষ নিজের কথা না ভেবে অর্থাৎ আত্মচিন্তায় নিমগ্ন না থেকে পরের মঙ্গলের জন্যে বা দেশ ও দশের হিতার্থে আত্মোৎসর্গ করে তাকে মহৎ মানুষ বলা হয়। মহৎ মানুষ হীনতা, দীনতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি দোষ থেকে দূরে থাকেন এবং সর্বদা সকল মানুষের মঙ্গলচিন্তা করেন এবং কাজের মধ্য দিয়ে মঙ্গল ও কল্যাণ সাধন করেন। সমাজে ভূরি ভূরি মহৎ মানুষের সাক্ষাৎ মেলে না সত্য, তবে সমাজে মহৎ মানুষ একেবারে যে বিরল তা-ও নয়। মহৎ মানুষের চিন্তা ও কর্ম সবসময় সমাজকেন্দ্রিক ও দেশকেন্দ্রিক। তাঁরা সব সময় দেশ ও জাতি, সমাজকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। কিভাবে দেশের মঙ্গল হবে, কিভাবে দেশের মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে সে সম্পর্কে তাঁরা সবসময় নিজেদের ব্যাপৃত রাখেন। তাঁরা কখনও নিজেদের কথা ভাবেন না, নিজেদের ভালো-মন্দের দিকে লক্ষ্য রাখেন না। তাঁরা আত্মচিন্তায় আবিষ্ট হয়ে নিজেদের অন্তরের উদারতাকে সীমিত সীমায় বন্দী করেন না। তাঁরা আলোকিত অন্তরের অধিকারী, তাঁরা সকল প্রকার কলুষ, সংকীর্ণতা, হীনতা ও ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেন এবং সে সাধনায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ব্রতী থাকেন; -বিচ্যুত হন না। 

কয়েকজন মহৎ মানুষের পরিচয় : মহত্ত্ব কী তা ভালোভাবে বুঝতে হলে কয়েকজন মহৎ মানুষের দৃষ্টান্তের আলোকে বুঝতে হবে। আমরা যে ক’জন মহৎ মানুষের কথা জানি তাঁদের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মহসীন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বেগম রোকেয়া সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হাজী মুহম্মদ মহসীন অগাধ সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনি তাঁর এই বিশাল বিষয়-সম্পত্তি নিজের ভোগে না লাগিয়ে অকাতরে দেশের মানুষের শিক্ষার জন্যে, দেশের মানুষের শিক্ষিত করে প্রকৃত মানুষ করার জন্যে দান করে গেছেন। এ ধরনের মানবপ্রেমী সমাজের কল্যাণকামী ব্যক্তি ক’জন আছেন? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দেশের মানুষের জন্যে তাঁর আয়ের অর্থ দান করে গেছেন। চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল তাঁর অর্থে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। তাঁর অর্থে আরও বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বেগম রোকেয়া নারী-শিক্ষা বিস্তারের জন্যে সংস্কারাচ্ছন্ন যুগে নিজের অর্থ ব্যয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নারীদের আত্মসচেতন করে তুলেছিলেন। তাঁর মহান জীবনাদর্শ আজও সকলের অনুকরণীয় হয়ে আছে। 

মানবতা ও মহত্ত্ব : মহত্ত্বের উৎস হল মানবতা বা মানবপ্রেম। যার হৃদয়ে মানবপ্রেমের শিক্ষা প্রজ্বলিত হয় সে-ই মহত্ত্বের পথে পা বাড়ায়। মানবপ্রেমিক মানুষ সদা-সর্বদা সামাজিকভাবে মানুষের কথা ভাবেন এবং মানুষের কিসে মঙ্গল হবে সেই চিন্তাকেই ধ্যানে পরিণত করেন। তিনি নিজের কথা ভাবেন না। হীন স্বার্থান্ধতা তাঁকে কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারে না। তিনি নিজেকে পরের মাঝে বিলিয়ে দেন এবং আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে যান। তিনি পরের সেবা করে পরমাত্মার সাযুজ্যলাভে ব্রতী হন। এভাবে জীবন-সাধনায় আত্মোৎসর্গ করে তিনি মহত্ত্বের মহিমায় মহীয়ান হয়ে ওঠেন। আপামর মানুষের মাঝে তিনি মহত্ত্বে জ্বলন্ত বিগ্রহ। মানুষ মহত্ত্বের পথে তিনি আহ্বান জানান সকলের অনুকরণীয় হয়ে বিরাজমান থাকেন। 

Leave a Comment