↬ দয়ার গুরুত্ব
ভূমিকা : ইংরেজ কবি Wordsworth লিখেছেন :
That best portion of good man’s life
His little, nameless, unremembered acts
Of kindness and of love.
বাঙলা প্রবাদেও আছে, “হিংসার-অধিক পাপ নেই, দয়ার-অধিক ধর্ম নেই”। দয়া মানুষের একটি মহৎ গুণ। পরকে দয়া দেখানোর প্রবৃত্তি মানুষের অন্তরে এমন একটি গুণের জন্ম দেয় যার সাহায্যে মানুষ মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে বহুদূর অগ্রগামী হতে পারে।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের আবেষ্টনীতে প্রত্যেক মানুষ প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাস করে। সমাজে যেমন ধনী ও বিত্তশালী লোক বাস করে তেমনি বাস করে দরিদ্র ও অসহায় লোক। সমাজে বসবাসরত দরিদ্র ও অসহায় লোকের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করাকেই দয়া বলা হয়। দয়া প্রদর্শনে অভ্যস্ত হলে অন্তরের সুপ্ত সদ্গুণগুলো জাগ্রত হয়ে ওঠে এবং তার দ্বারা মানুষ আত্মত্যাগের আদর্শে দীক্ষালাভ করে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সমাজে প্রম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্যে দয়ার অনুশীলন অপরিহার্য।
সত্যিকারের দয়া কী? : দয়া প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে আমরা সাধারণভাবে বুঝি যে, ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়া। আসলে দয়া প্রদর্শনের স্বরূপ কিন্তু তা নয়। সার্থকভাবে দয়া প্রদর্শন করতে হলে একজন দীন-দরিদ্রকে এমনভাবে দয়া দেখাতে হবে যা দ্বারা তার অভাব চিরতরে দূর হয় এবং সে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে, অর্থাৎ স্বাবলম্বী হতে পারে। অনেকে নিজের নাম জাহির করার জন্যে সস্তা পন্থায় দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়ে থাকে। এতে তার আত্মার মঙ্গল হয় না, বরং আত্মা কলুষিত হয়ে ওঠে। তাই পরম আন্তরিকতার সঙ্গে দয়া পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে দয়া দেখাতে হবে। দয়া সকলকে দেখানো যায়,- বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সকলকে। সত্যিকারভাবে দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে মানবাত্মার উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে।
ধর্মপুস্তকে দয়া প্রদর্শনের বর্ণনা : আমাদের কোরআনে বর্ণিত আছে যে, ডান হাতে দান করলে বাম হাতে যেন না জানে,- অর্থাৎ দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে যেন কোনোভাবেই গর্ব বা অহঙ্কার প্রকাশ না পায়। বাইবেলে বলা হয়েছে, দরিদ্রের প্রতি দয়া বা অনুকম্পা দেখানোর অর্থ হল সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
দয়া সম্পর্কে জনসমর্থিত বিশ্বাস : মুসলমানগুণ প্রকৃতিগতভাবেই দনশীল। তারা যে ধর্ম-শিক্ষায় শিক্ষিত সে শিক্ষা ভিখারিকে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষা দেয় না, বরং ভিখারির প্রতি সদয় ব্যবহার করার শিক্ষা দেয়। নিরন্ন মানুষকে অন্নদান করা মুসলমানদের হৃদয়ের ব্রত। প্রতিটি মুসলমান আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, যদি তারা ভুখা-নাঙ্গা মানুষের প্রতি সদয় না হয় তাহলে তার সৃষ্টিকর্তার রোষানলে পড়বেই। সুতরাং ইসলাম ধর্মে দয়া-দাক্ষিণ্যের মহিমাকে অনেক উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে যে যাকাতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সে ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে দয়ার মহিমাই ব্যক্ত করে।
চরিত্র গঠনে দয়ার ভূমিকা : চরিত্র মানবজীবনের অলংকার। সচ্চরিত্রবান মানুষের মহত্ত্ব ও খ্যাতি দয়াব্রতে আরো মধুর হয়ে ওঠে। জগতে যারা মানুষ ও জীবের প্রতি অত্যাচার ও দুর্ব্যবহার করে গেছে তাদের জীবন ও ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছে। হালাকু খাঁ, নাদির শাহ, তৈমুর লং, হিটলার প্রমুখের নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা ছিল লোমহর্ষক। আবার স্বভাব থেকে নিষ্ঠুরতা পরিহার করে কেউ কেউ মানুষ ও জীবের প্রতি সেবাকর্মে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের সংগঠক সম্রাট আশোককে চণ্ডাশোক নামে অভিহিত করা হয়। এ যুদ্ধে এক লক্ষ মানুষ নিহত, দেড় লক্ষ দেশান্তরিত এবং এর বহুগুণ যুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। যুদ্ধের সর্বনাশা রূপ অশোকের মনকে শোক, দুঃখ ও অনুশোচনায় মুহ্যমান করে তোলে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ধর্মপ্রাণ হয়ে ওঠেন। পরবর্তী ত্রিশ বছরে তিনি আর কোনো যুদ্ধ করেন নি। ক্ষমাকেই জীবনের মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। জীবের প্রতি দয়ার্দ্র হয়েই অশোকের মন বিগলিত হয়েছিল। সে জীব মানুষই হোক কিংবা পশুই হোক। খলিফা হযরত উমর (রা)-এর নামও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনিও প্রথম জীবনের দুর্দান্ত স্বভাব পরিত্যাগ করে কোমলমতি হয়ে উঠেছিলেন। চাকরকে উটের পিঠে উঠিয়ে রশি ধরে তিনি হেঁটেছেন। পরের প্রতি মমতা মানুষকে কত উচ্চমার্গে পৌঁছে দিতে পারে আমিরুল মোমেনীয় হযরত উমর (রা)-এর চরিত্র-মাহাত্ম্য ও জীবনাদর্শ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।