ছেলেবেলার একটি মধুর স্মৃতি আজো আমাকে ভীষণভাবে দোলা দেয়। আমি ঘুমিয়ে থাকি। বাবা আমার কপালে হাত বুলিয়ে আবৃত্তি করছেন :
“ভোর হল, দোর খোল, খুকুমণি ওঠ রে।
ঐ ডাকে জুঁইশাখে ফুলখুকী ছোট রে। ”
নজরুলের জন্ম বর্ধমান জেলার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। পিতা কাজী ফকির আহমদ এবং মা জাহেদা খাতুন তাঁদের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হওয়ায় তাঁর নাম রাখেন ‘দুখু মিয়া’। তাঁর পুরো ছেলেবেলাই কেটেছে অপরিসীম দারিদ্র্যে। পিতৃবিয়োগের পর তিনি আরো অর্থকষ্টে পড়েন। অভিভাবকহীনতায় হয়ে ওঠেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল, দিশেহারা। গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন বর্ধমান জেলার একটি হাইস্কুলে। সেখান থেকে চলে যান ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলে। কিন্তু এখানেও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলেন না কিছুটা অর্থকষ্ট, কিছুটা ছন্নছাড়া স্বভাবের কারণে। এসময় তিনি যোগ দেন ‘লেটো’ দলে। পরে অবশ্য শিয়ারশোল হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা নির্বাচনী পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং এ পর্যন্তই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে নজরুলের আবিরর্ভাব ঝড়ো হওয়ার মতো। তিনি বাঙালির জীবনে জাগিয়েছিলেন নতুন জীবন তরঙ্গ। তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি পদ্য রচনা, গীতা রচনা আর পালাগান রচনা করে তাতে সুরারোপ করেন। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। নজরুল হয়ে ওঠেন কবিয়াল-গাইয়ে। এই শক্তিই তাঁকে ভবিষ্যতে অসংখ্য সংগীত রচনায় সিদ্ধহস্ত করে তোলে। সংগীতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তাঁর এ দক্ষতা আমাকে বরাবরই অবাক করে।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সম্পর্কে তিনি স্কুলজীবনেই অবগত হন। সৈনিক জীবনে তিনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হন প্রচণ্ডভাবে। কবি ইংরেজদের হয়ে লড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ তাঁর মনটাকে বিষিয়ে দিল। তাঁর প্রথম যুগের কবিতা ও গানে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চেতনা, আন্তর্জাতিকতা ও গভীর দেশপ্রেম। আর সৈনিক জীবনের যুদ্ধ ও বিপ্লব তাঁর লেখনীকে নতুন মাত্রা দেয়। এত অল্প বয়সে এমন গভীর জীবনবোধ আমাকে বিস্মিত করে।
দেশব্যাপী যখন পরাধীনতার অন্ধকার, সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী থাবা বিস্তৃত চারিদিকে, অসহযোগ আন্দোলনের জননেতারা বন্দি, তখন তিনি লিখলেন :
“কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী। ”
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হলো-
‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। ’
জীবনের গভীরে প্রোথিত বিশ্বাস থেকে তাঁর কবিতা পেয়েছে বক্তব্যের বলিষ্ঠতা, জীবনের দুঃখকষ্টের তীব্রতা আর অকপটতা। নজরুল তাঁর কবিতায় আর্ত-পীড়িতদের কথা বলেছেন। সর্বজীবে সাম্যভাব তাঁর রচনার মূল কথা। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন :
‘দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
নজরুলের কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে নজরুল তাঁর শক্তিশালী কলমকে হাতিয়ার করেন। তিনি লিখলেন, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘পথের দিশা’, ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কবিতা। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী থেকে বেরিয়ে এলো চিরন্তন সত্য-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’
জাত প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁর কণ্ঠ হয়েছে সোচ্চার-
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া!
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
—- —- —- —- —- —- —- —-
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্মপর।
বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন্ সে জাতি? ”
স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রূপমুগ্ধ কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছে-
‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী। ’
দেশকে তিনি ভালোবেসেছেন অন্তর দিয়ে। কারাবরণ করেছেন, প্রচণ্ড অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবুও জননী জন্মভূমির এতটুকু অসম্মানও সহ্য করেন নি। তাই দেশের সেবায় আত্মত্যাগ করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন।
নারী ও পুরুষ তাঁর চোখে ছিল সমান, যা আজকের যুগেও অনেকে মেনে নিতে চান না। নারী-পুরুষের সাম্য নিয়ে তিনি লিখেছেন :
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ’
বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি কখনো কখনো প্রেম-পিপাসু। এই প্রেম কবিকে পাওয়ার আনন্দ যেমন মশগুল করেছে তেমনি না-পাওয়ার বেদনায় করেছে বেদনাহত- বিরহী কবি লিখেছেন :
‘তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া।
তোমার বন্দনা করি…..।
হে আমার মানস-রঙ্গিণী ’