একটি স্মরণীয় ঘটনা
নাহ্, ক্লাসে আজ কিছুতেই মন বসছে না । সময় যেন আজ আর কাটছেই না । মান্নান স্যার, জহির স্যার, নির্মল স্যারের ক্লাসে একটি কথাও আমার কানে ঢুকেনি । কারণ স্কুলে গিয়ে যখন শুনলাম একজন অদ্ভুত ধরনের বাজিকর আজ নানারকম আশ্চর্য খেলা দেখাবে, তখন থেকেই মনটা আনন্দে অধীর হয়েছিল । ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি সবার আগে গিয়ে স্কুলের মাঠে উপস্থিত হলাম । অতঃপর সারা স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা হই হই করে সেখানে এসে হাজির হলো । নানা ধরনের কথা, হাসি, চিৎকার, শিস প্রভৃতি ধ্বনিতে মাঠটি গোলমাল মুখর হয়ে উঠল । হঠাৎ তাদের গোলমাল ছাপিয়ে ডুগ ডুগ ডুগ আওয়াজ হলো । অমনি বাজিকর এসেছে, বাজিকর এসেছে— বলে একটা সাড়া পড়ে গেল ।
লোকটাকে দেখলাম। মাথায় আধময়লা একটা পাগড়ি, তারই পাশ দিয়ে পাকা শনের মতো লম্বা সাদা চুল দুদিকে সারি করে ঝুলে পড়েছে। মুখে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি লম্বা সাদা গোঁফ দুই পাশে পাকানো । লোকটার গায়ে শতছিন্ন তালি দেওয়া একটি কালো রঙের কোট। পরনে লুঙ্গির মতোন একটি ময়লা কাপড়। কাঁধে হেলানো কালো রঙের লাঠিতে মস্ত একটা ঝোলা ঝুলছে । লোকটার সঙ্গে একটা ছেলে । প্রথমে ছেলেটি আমার চোখে পড়েনি। ছেলেটির পরনে নীল হাফ প্যান্ট, গায়ে কিছু নেই । জানতে পারলাম ছেলেটা বুড়ো লোকটার নাতি। এরা দুজন মিলেই খেলা দেখায়। ছেলেটাও অবাক হওয়ার মতো খেলা দেখাতে পারে । বুড়ো বাজিকর ঝোলার সাজসরঞ্জাম একে একে বের করে খোলা মাঠ সাজিয়ে ফেলল । পুনরায় ডুগ-ডুগির শব্দ হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো বিভিন্ন রকম অদ্ভুত ভঙ্গিতে বকতে শুরু করল। তার কথাগুলোর মধ্যেই কেমন একটা আকর্ষণ ছিল, যা শুনলেই মন কৌতূহলী হয়ে ওঠে। খেলা শুরু হয়ে গেল । দেখতে দেখতে এক কৌটা চাল মুড়ি হয়ে গেল । এরপর উপর দিকে ছুড়ে ফেলা একটা আংটি একটা আস্ত বেগুনের ভিতরে থেকে বেরিয়ে এলো। এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার স্যারের ফাউন্টেন পেন হেড মাস্টার স্যারের জামার পকেট থেকে বেরুলো। অনিকের গায়ের সিল্কের জামাটা চেয়ে নিয়ে বাজিকর টুকরো টুকরো করে ফেলল এবং পরক্ষণেই তার ঝোলার ভেতর থেকে জামাটা আস্ত বের করে দেখালো। এরপর দেখালো এক লোমহর্ষক খেলা । একটা ঝাঁপির মধ্যে ঢাকনা চাপা দিয়ে ছেলেটি বসে রইল, আর বুড়ো একখানা ধারাল তলোয়ার এফোঁড় ওফোঁড় করে চালিয়ে দিল তার মধ্য দিয়ে, কিন্তু ছেলেটার কিছুই হলো না। ঢাকনা খুললে বের হলো একটি কালো ভেড়া, ছেলেটা কোথায়? সবাই তাজ্জব বনে গেল । বেলা বাড়ছে, সঙ্গে ডুগডুগি বাজছে। হঠাৎ সেই ছেলেটা সবার সামনে এসে দাঁড়াল। অবশেষে বুড়োর ভাষ্যমতে শেষ খেলা শুরু হলো । সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই ছেলেটি একটি সরু বাঁশ বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে । শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি । সমস্ত মাঠে পিনপতন নীরবতা। ছেলেটার সাহস আছে বটে । বাঁশটা তির তির করে কাঁপছে, তবু সে বাঁশের মাথায় উঠে বসলো । তারপর সেই উঁচু বাঁশের মাথায় বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে নানাভাবে খেলা দেখাতে লাগল । সবাই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছে ছেলেটার দুঃসাহসিক কসরত। এবার ছেলেটা বাঁশের মাথায় পেটের ওপর ভর দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল । কিন্তু হায়! শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে ফসকে গেল বাঁশ। বাঁশটা জোরে কেঁপে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল । অমনি ‘গেল, গেল’ বলে সমস্বরে চিৎকার উঠল । ঘাড়টা একেবারে ভেঙে গেল ছেলেটির । মুখ দিয়ে অনেকটা রক্তও বেরুল । ‘আহা, মরে গেল’ বলে অনেকে আফসোস করতে লাগল । তবু একদল ছেলে তাকে বয়ে নিয়ে চলল হাসপাতালের দিকে। বুড়ো পাগলের মতো ছুটলো তাদের পেছন পেছন । তার ভাঙা গলায় অর্ধ-অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ শুনতে পেলাম বাহাদুর ইব্রাহিম। ক্রমে মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল । দেখতে পেলাম মাঠের মাঝে সবুজ ঘাসের ওপর একচাপ রক্ত। স্কুলের সেদিনের সেই স্মরণীয় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আজও আমি ভুলতে পারিনি ।